১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সকাল দশটায় ক্যাবিনেট মিটিং এ বসেছেন। উপস্থিত আছেন পররাষ্ট্র্র মন্ত্রী সর্দার স্বরন সিং, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, কৃষিমন্ত্রী ফখ্রুদ্দিন আলী আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ইশান্ত রাও আর আছেন সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ। শুরুতেই ইন্দিরা পশ্চিম বঙ্গ, আসাম আর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদের শরনার্থী সমস্যা সংক্রান্ত মেসেজগুলো পড়ে শোনালেন। তারপর মানেকশর দিকে ফিরে বললেন, ‘আমি চাইছি, আপনি পুর্ব পাকিস্তানে ঢুকুন।’ মানেকশ বললেন, ‘আপনি কি জানেন, এর মানে যুদ্ধ!’ ইন্দিরা বললেন, ‘কুচ পরোয়া নেহি।’
মানেকশ বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি বাইবেল পড়েছেন?’
পররাষ্ট্র্র মন্ত্রী সর্দার স্বরন সিং বললেন, ‘এর সাথে বাইবেলের কি সম্পর্ক?’
মানেকশ বললেন, ‘এই আদি বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারের প্রথম প্যারাগ্রাফের প্রথম লাইনে ঈশ্বর বললেন, “আলোকিত হও,” অমনি চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। তেমনি আপনি যদি বলেন, “যুদ্ধ শুরু হোক,” যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাদের কি ধারনা, আমরা একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত? আজ ২৮ এপ্রিল। বরফ গলে হিমালয়ের পথগুলো খুলতে শুরু করেছে। এমন সময় যদি চায়নিজরা আল্টিমেটাম দিয়ে বসে, আমাদের কিন্তু তখন দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হবে।’
সর্দার স্বরন সিং আবার মুখ খুললেন, ‘চায়নিজরা কি আল্টিমেটাম দেবে নাকি?’
মানেকশ বললেন, ‘আপনিইতো পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী, আপনিই বলুন, দেবে কিনা?’ এবার মানেকশ ইন্দিরার দিকে ফিরে বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গতবছর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আপনি চাননি কমুনিস্টরা জিতুক, তাই আপনি বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সব শহর গ্রামে ছোট ছোট দলে সেনা মোতায়েন করতে। আমার দুই ডিভিশন সেনা তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই সেকশন আর প্লাটুন হিসেবে এখনো ওখানে মোতায়েন আছে। ন্যুনতম একমাস লাগবে ওদের ইউনিটে ফিরিয়ে এনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। এছাড়াও আমার একটা ডিভিশন আসামে, অরেকটা অন্ধ্র প্রদেশে, আর আর্মার্ড ডিভিশনটা আছে জানশি-বাবিনাতে। ন্যুনতম একমাস লাগবে এদের ফিরিয়ে এনে সঠিক পজিশনে বসাতে। এদের নড়াতে দেশের প্রত্যেকটা রাস্তা, প্রত্যেকটা রেলগাড়ী, প্রত্যেকটা ট্রাক, প্রত্যেকটা ওয়াগন আমার লাগবে। এই অবস্থায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর উত্তর প্রদেশের ফসল স্থানান্তর অসম্ভব হয়ে যাবে। একারনে দেশে যদি দুর্ভিক্ষ হয়, তখন কিন্তু সবাই কৃষি মন্ত্রীকেই দুষবে, আমাকে না। তাছাড়া আমার আর্মার্ড ডিভিশনে সাকুল্যে তেরটা ট্যাঙ্ক সচল আছে এই মুহূর্তে।’
অর্থমন্ত্রী অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘মাত্র তেরটা কেন?’
মানেকশ জবাব দিলেন, ‘কারন আপনি অর্থমন্ত্রী, তাই। গত দেড় বছর ধরে আমি টাকা চাচ্ছি, কিন্তু আপনি বলছেন, কোন টাকা নেই, তাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখন এপ্রিলের শেষ। আমি প্রস্তুত হতে হতে পুর্ব পাকিস্তানে বর্ষা শুরু হয়ে যাবে। আর বর্ষা কালে ওখানে শুধু বৃষ্টি হয়না, যেন আকাশ ভেঙে পানি পরে। নদী হয়ে যায় সাগরের মত, আপনি যদি এক পাড়ে দাঁড়ান অন্য পাড় দেখতে পারবেন না, আর আশেপাশের সব এলাকায় বন্যা শুরু হয়ে যায়। তাই আমার সব মুভমেন্ট রাস্তার ওপর সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। বিমানবাহিনীও সেভাবে কাজে আসবে না। এই অবস্থায় আপনি যদি আমাকে পুর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে বলেন, তো আমি আপনাকে শতভাগ পরাজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারি। আপনি আমার কতৃপক্ষ, এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, আমার জন্য কি আদেশ?’
ইন্দিরা গান্ধী বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন এবং মানেকশ’কে স্বাধীনভাবে পরিকল্পনা করে জানাতে বলেছিলেন কবে নাগাদ তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। মানেকশ ‘অপারেশন জ্যাকপট’ প্ল্যান করেছিলেন, এবং মুক্তিযোদ্ধা আর বাংলাদেশীদের সহায়তায় ‘লাইটেনিং কেম্পেইন’-এর মাধ্যমে ৯৩ হাজার পাক সেনাসহ নিয়াজিকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিলেন।
গ্রন্থ সুত্রঃ
অধ্যায়-১০ (টেরেইন), আধুনিক দৃষ্টিকোণে সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার
মেজর মোঃ দেলোয়ার হোসেন, এসপিপি, পিএসসি
নালন্দা প্রকাশনী
https://www.rokomari.com/book/163714/adhunik-drishtikore-sun-tzur–the-art-of-war