আমরা ভাবতে ভালবাসি যে আমরা আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা আর আমাদের অমর বীরশ্রেষ্ঠদের কথা খুব ভাল করেই জানি। কিন্তু সত্যিই কী তাই? সত্য হল আমাদের অনেকেই আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠদের নামও নির্ভুল ভাবে জানিনা। জানিনা কবে, কোথায়, কীভাবে তারা শহীদ হলেন, কেনইবা তারা বীরদের মাঝেও বীরশ্রেষ্ঠ?
সাধারন ইতিহাস আর সমর ইতিহাসে মধ্যে মজার কিছু পার্থক্য আছে। নেপোলিয়ন ওয়াটার লুর যুদ্ধে হেরেছিলেন এটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা। কিন্তু সমর ইতিহাসবিদেরা ওয়াটার লুর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আর রণকৌশলগত ইতিহাস সংরক্ষন করে থাকেন। ইতিহাসের পাশাপাশি তারা যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কারনও বিশ্লেষন করেন ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য। তাই যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রে ইতিহাস আর সমর ইতিহাসের সমন্বয় হয়ে উঠে অত্যন্ত উপভোগ্য আর শিক্ষনীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও এমনিভাবে ঐতিহাসিক আর সমর ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ আর প্রেক্ষাপটে জানবার অবকাশ আছে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম আর ১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের যোগফলই হল আমাদের পরম আরাধ্য স্বাধীনতা। হার না মানা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যে প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল, ২৫ শে মার্চের কাল রাতে পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তা অদম্য স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।
একটা যুদ্ধে যুদ্ধরত সবাই যোদ্ধা, কিন্তু সব যোদ্ধাই কিন্তু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন না। দিনের পর দিন দীর্ঘ নয় মাস ধরে স্বাধীন বাংলা বেতারে যিনি মুক্তির গান গেয়েছেন, বিদেশী দূতাবাসের সামনে যিনি স্বাধীনতার জন্য অনশনে বসেছিলেন, হানাদারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনমত গড়তে যিনি কলম ধরেছিলেন, নিজে অভুক্ত থেকেও যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একথালা ভাত এগিয়ে দিতেন, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে যাবার আগে এক দন্ড ঘুমাতে দিয়ে নিজে রাত জেগে ঠায় দাড়িয়ে পাহারা দিতেন, যিনি পরম মমতায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রসা আর নিহতদের সতকার করতেন, যিনি পাকসেনাদের গতিবিধি দেখে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিয়ে যেতেন, যিনি হন্যে হয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য রিক্রুট খুঁজে আনতেন আর নিখরচায় প্রশিক্ষন দিয়ে যেতেন, যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা ভিনদেশি অফিসের দ্বারে দ্বারে ধর্না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এমুনিশন আর শরনার্থীদের জন্য ত্রান আনার ভিক্ষা করতেন; তাদের সবাইও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র অধ্যায়, যার মাধ্যমে সংগ্রামের যবনিকাপাত হয়ে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার নুতন সূর্য। তাই সব সংগ্রামী আর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মত্যাগ, সংকল্প, দৃঢ়তা, সংযম, সাহস আর শৌর্যদীপ্ত অবদানের কারনে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন, এবং হয়ে থাকবেন চিরদিন। আবার এই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ভীরে কিছু মৃত্যুহীন প্রান রনাঙ্গনে সম্মুখসমরে অকুতভয়ে লড়ে পাকসেনাদের হারিয়ে দিতে গিয়ে, আর সহযোদ্ধাদের প্রান বাঁচাতে গিয়ে সমর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বীরদের মত নির্দ্বিধায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন।
এদের কারো মৃত্যুই কিন্তু নিছক দূর্ঘটনা ছিলনা। রউফ, নুর মোহাম্মদ আর মোস্তফা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতই প্রতিরক্ষায় দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরন করে নিয়েছিলেন সহযোদ্ধাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণ নিশ্চিত করতে। জাহাংগীর আর হামিদুর বুলেট বৃষ্টি ফুঁড়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন দুর্দমনীয় দুঃসাহসিকতায়। মতিউর আর রুহুল আমিন রেখে গেছেন অমোঘ প্রেষনার অনন্যসাধারন দৃষ্টান্ত। তাই তো তারা সকল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বীরকূলের শিরমনি। তারা আমাদের অন্তহীন প্রেষণা আর প্রেরণার উতস; আমাদের গৌরব, পৌরষ আর অহংকার! আসুন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠদের জানি, জানি আমাদের বীরশ্রেষ্ঠদের অমর বীরগাথা।
কিন্তু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধই কী আমাদের শেষ যুদ্ধ? তা তো নয়। কথায় আছে ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।‘ তাই সার্বভৌমত্ব আর ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষার যুদ্ধের পাশাপাশি আছে সামাজিক-অর্থনৈতিক সহ নানাবিধ মুক্তির জন্য যুদ্ধের সমুহ সম্ভাবনা। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নব্য মুক্তিযোদ্ধারা জন্মাবে, নব্য বীররাও জন্ম নেবে; এটাই সত্য আর ভবিতব্য। তেমনি এক নব্য বীর আমাদের লেফটেন্যান্ট মুসফিক; স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের প্রথম বীর উত্তম তিনি; প্রান দিয়ে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের অখন্ডতা নিশ্চিত করতে। তাই ‘বাংলাদেশের বীর গাথা’ তে লেফটেন্যান্ট মুসফিকের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশী বীরত্বের গৌরদীপ্ত ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থেই।
বইটিতে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ আর একজন বীর উত্তমের কাহিনী সাজানো হয়েছে তাদের মৃত্যুর তারিখের ধারাবাহিকতায়। তাদের বীরোচিত মৃত্যুর দৃশ্যটি চিত্রায়নে তথ্য, যুক্তি আর অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে সর্বোচ্চতম সতর্কতায়। এছাড়াও সর্বোচ্চ নির্ভরযোগ্য সুত্র হতে সংগৃহীত জীবনীও জুড়ে দেয়া হয়েছে প্রত্যেকটি বীর গাথার শেষে। ‘বাংলাদেশের বীরগাথা’ আদতে একটা ‘স্বপ্ন প্রকল্প।‘ আমরা চেয়েছি এক মলাটে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য উপযোগী করে আমাদের বীরদের বীরগাথাগুলো প্রকাশ করতে। এই ‘স্বপ্ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে প্রকাশক, ইলাস্ট্রেটর সহ আমাদের সকলের প্রচেষ্টা ছিল সহজাত পেশাদারিত্বের চেয়েও বেশি কিছু। প্রজন্ম একাত্তরের এই অমোঘ আবেগকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমাদের কারোরই ছিলনা আসলে। আশাকরি আমাদের এই ঐকান্তিক প্রয়াস আপনাদের ভালই লাগবে। ধন্যবাদ।