এক
হটাত দূর দিগন্তে আবছা নড়াচড়া টের পেয়ে মুহুর্তেই বাস্তবে ফিরে এলাম। নিজেকে ফের মনে করিয়ে দিলাম যে, যদিও এই মাঝ রাতে একটা সাভান্নাহতেই বসে আছি, কিন্তু উপলক্ষ্যটা আর যাই হোক, সাফারি না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেন্ট্রি নিশ্চিত করল, ক্রিস্মাসের পার্টি শেষে কোনএক মাতাল বাড়ি ফিরছে। এতোটাই গিলেছে যে, চলতে চলতে পেটমোটা এম আই-৮ হেলিকপ্টারের দেয়াল ধরে হর হর করে একগাদা বমি করল, তারপর ‘মেরি ক্রিস্মাস’ বলতে বলতে কোন জিজ্ঞাসা ছাড়াই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।পরদিন ছিল ক্রিস্মাসের ছুটি, তাই মুভি আর ইন্টারনেটের কল্যানে রাতের অনেকটাই নির্ঘুম পার করেছি। অতএব লম্বা একটা ঘুম পাওনাই ছিল। ঘুমটা আরেকটু লম্বা হতে পারত। কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কোম্পানি কমান্ডারের ডাক পরল। তিনি জানতে চাইলেন, এক্ষুনি একটা ফোর্স প্রটেকশন পেট্রল নিয়ে বেরুতে হবে, পারব কিনা? সম্মতি জানাতেই বললেন, ‘হারি আপ।’ এসাইনমেন্ট পাবার পর অফিসাররা এমনিতেই যথেস্ট ‘হারি’ তে থাকে। উপরন্তু ‘হারি আপ’ বলা মানে ব্যাপার গুরুতর, এবং দ্রুততম রেস্পন্স কাংখিত। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে রুমের বাইরে এসে দেখি জীপ সমেত কোম্পানি কমান্ডার নিজেই উপস্থিত। উঠে বসতেই জীপ ছুটে চলল জুবা মুভকন (অস্থায়ী বিমানবন্দর) এর দিকে। জানলাম আমার জন্য একটা আস্ত হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে!

জীপে যেতে যেতেই এসাইনমেন্টের শানে নুযুল জেনে নিলাম। ঘটনা হল, ইউ এন এর একটা রাশান হেলিকপ্টার ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার লাফোন এলাকায় নস্ট হয়ে পরে আছে। হেলিকপ্টারটা দক্ষিন সুদানের স্বাধীনতার জন্য আসন্ন গনভোটের পর্যবেক্ষকদের নিয়ে সুদান চষে বেড়াতে বেড়াতে লাফোনে গিয়ে আর স্টার্ট নিচ্ছেনা। বেলা পরে গেছে আজ, তাই জুবা থেকে একটা হেলিকপ্টারে করে আমরা ফোর্স প্রোটেকশন নিয়ে যাব রাত জেগে ঐ নস্ট হেলিকপ্টারটা পাহারা দিতে আর এই হেলিকপ্টারে করে আটকে পড়া পর্যবেক্ষক আর নস্ট হেলিকপ্টারের ক্রুরা জুবা ফিরে আসবে।সাধারনত দিনের রুটিন ফোর্স প্রোটেকশন পেট্রলগুলো জেসিও এনসিও রাই লিড করে থাকেন। কিন্তু মেইন বেইজ থেকে এতোটা দূরে গিয়ে রাতে ফোর্স প্রোটেকশন দেয়ার কথা ভেবে শেষমুহুর্তে একজন অফিসার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। যেকোন জরুরী পরিস্থিতির মজার বিষয় হল অনেক রুটিন ফর্মালিটিজ স্কিপ করা যায়। আজ যেমন উটকো ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ ছাড়াই সোজা রানওয়েতে পৌছে দেখি দশজনের একটা পেট্রল ইতোমধ্যে অপেক্ষায় আছে। সবাই আমার মতই ঘুম থেকে উঠেই এসেছে বলে মনে হল। সবারই ছুটির দিনটা মাটি হচ্ছে! সবচে বিমর্ষ দেখাচ্ছে দুজন ভিনদেশী মিলিটারি অবজারভারকে। থেমে থেমে এরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘হোয়াই আস?’রাতে উড়ার উপযোগি এই রাশান হেলিকপ্টারটা দেখলাম কিছুটা অন্যরকম। আরদশটার চেয়ে কিছুটা ভারী মনে হল। অনেকক্ষন ধরে রোটর ঘুরছে। কান তালা লেগে যাবার উপক্রম। অবশেষে চড়ে বসার সিগন্যাল এল। চড়ে বসতেই পাইলট বলল অন্তত দুইজনকে নেমে যেতে হবে। পেট্রলের অস্ত্র-গোলাবারুদ সহ ওজন সম্ভবত বেশি হয়ে গেছে। মুহুর্তের ভেতর মিলিটারি অবজারভার দুইজন কেটে পড়ল।
৪৫ মিনিটের আকাশ যাত্রা শেষে লাফোনের আকাশে পৌছে গেলাম। ইতোমধ্যে চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাটি ছুঁইছুঁই অবস্থায় হেলিকপ্টারটা চারপাশে ধুলার মেঘ বানিয়ে ভাসতে থাকল। আমরা একে একে নেমে যেতেই, টপাটপ আটকে পড়া পর্যবেক্ষক আর নস্ট হেলিকপ্টারের ক্রুরা উঠে বসে গেল। মাটিতে পা দিয়ে ধাতস্ত হবার আগেই চারপাশের ধুলার মেঘটাকে আরো গাঢ় করে দিয়ে হুশ করে হেলিকপ্টারটা উড়ে গেল। ধুলার টর্নেডোটা কেটে যেতেই তারার আলোয় কিছুদুরে অলস পড়ে থাকা নস্ট হেলিকপ্টারের অবয়বটা চোখে পড়ল। পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোনটা বের করে জুবায় জানিয়ে দিলাম যে নিরাপদেই এসে পৌছেছি।যাবার আগে রাশান পাইলটরা হেলিকপ্টাররের দরজা লক করে গেছে। উপরে চাঁদ হীন তারা ভরা আকাশ। চারপাশে যতদুর দেখা যায় ছোট ছোট কাটা ঝোপের প্রান্তর। বড় কোন গাছ নেই। দিগন্ত জুড়ে ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার পর্বতের সারি আবছা চোখে পড়ে। দূরে কিছু বিক্ষিপ্ত আলো দেখে জনপদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, আর ওদিক থেকেই ভেসে আসা ভোতা অস্পস্ট মিউজিকের শব্দে ঠাহর করে নেয়া যায়, ঐটাই লাফোন গ্রাম। গ্রাম বলতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু কুড়েঘর, স্থানীয়রা বলে টুকুল। আন্দাজে বলে দিতে পারি, আজ ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে সবাই জড়ো হয়ে চোলাই মদ গিলছে আর হৈ হল্লা করছে। মাঝরাতের পর এই আড্ডা ভাংবে হয়ত।নিজেদের দিকে নজর দিলাম এবার। দিনের আলো পাইনি তাই চারপাশটা দেখার সুযোগ হয়নি। এখন আর সম্ভবও না। দুষ্কৃতিকারীদের ভয় তো আছেই, সেই সাথে মাতাল গ্রামবাসীদেরও বিশ্বাস নেই। এরা জন্মগতভাবেই বেশ উগ্র। বাংলাদেশী শান্তীরক্ষীদের প্রতি যদিও এদের আলাদা কোন দ্বেষ নেই, তবে রাত বিরাতে হেলিকপ্টার ভাঙ্গার শখ হওয়াটা এদের জন্য বিচিত্র কিছু না। যুদ্ধ এবং শান্তিরক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ইউএন শান্তিরক্ষিদের অবস্থান জানান দেবার একটা বাধ্যবাধকতা আছে। সাধারন যোদ্ধা প্রতিকুল এলাকায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এখানে অবস্থা বিচিত্র। কেউ যদি আক্রমন করে বসে, ইউএন এর ঝান্ডা দেখিয়ে এই রাতের বেলা পার পাওয়া যাবেনা। রাতে মেরে কেটে মোরব্বা বানিয়ে সকালে যদি বলে অন্ধকারে ঠাহর করতে পারি নাই। ইউএন মাইন্ড করবে না এবং আমাদের আটটা লাশ সুন্দর কফিনে করে দেশে পাঠিয়ে দেবে সানন্দে।অগত্যা আটজনে মিলেই ম্যানেজেবল একটা সিকিউরিটি পেরিমিটার দাড় করিয়ে ফেললাম। যে পরিমান ফায়ার পাওয়ার আছে তাতে আপাতত ট্যাঙ্ক নিয়ে না আসা পর্যন্ত কোন ভয় দেখিনা। তাছাড়া নিকটস্থ বাংলাদেশী ক্যাম্প টরিটের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। সমস্যা হলে ঘন্টা তিনেকের ভেতর পৌছে যাবে। বিষয়টা হল তিন ঘন্টা পর্যন্ত টিকে থাকা। কিন্তু কেউ যদি আহত হয় তাকে ট্রিট করার মত একটাও আড় নেই আশে পাশে। চোখ পড়ল হেলিকপ্টারটার ওপর। এম আই-৮ বেশ শক্ত ফড়িং বলেই জানতাম। রকেট লাঞ্চার ছাড়া এর চামরা ভেদ করা সাধারন বুলেটের সাধ্যি না। কিন্তু শালার রাশানরা সব দরজা লক করে গেছে যাবার আগে।আমার ভাবনাটা টের পেয়েই দুজনকে দেখলাম টর্চের আলো ফেলে হেলিকপ্টারের চারপাশের হাতল টেনেটুনে দেখছে। হঠাত একটা হাতলে টান পড়তেই দেখি দরজাটা নড়ে উঠল। কাছে গিয়ে দেখি হাতলের নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা ‘ইমার্জেন্সি’। দরজা খুলে আমাদের ভারী অয়্যারলেস সেট আর অন্যান্য বাড়তি জিনিসপত্র হেলিকপ্টারের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। মাঝরাতের পর চাঁদ উঠল।সবকটা পোস্ট আরেকবার ঘুরে এসে হেলিকপ্টারের ভেতর জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। এখানকার আকাশ বাতাস এতোটাই পরিস্কার যে, এখানকার আকাশে আমি এমন অনেক তারা দেখেছি যা আগে কখনই দেশের আকাশে দেখতে পাইনি। এখানকার চাদটাকেও আমার দেখতে অনেকটা বড় আর উজ্জ্বল লাগে। নিরক্ষরেখার কাছে বলেই কি এমনটা হয়? কি জানি! ঢকঢক করে একবোতল পানি গিলে জানাল বাইরে সাভান্নাহ জুড়ে জ্যোৎস্নার জোয়ার দেখতে দেখতে ভাবি, ‘ইউএন মিশনে আসছি, নাকি সাফারিতে?’
দুই
দাগ হ্যামারশেল্ড, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বলেছিলেন, “শান্তিরক্ষা সৈনিকের কাজ না, অথচ একমাত্র সৈনিকেরাই পারে শান্তিরক্ষা করতে।” তো হ্যামারশেল্ড সাহেবের মতের সাথে দ্বিমত করতে না পেরেই বুঝি ২০০৯ এর জুন মাসের কোনএক সকালে আমার বর্তমান কর্মস্থল এক অনাড়ম্বর ‘টি-আউট’ এর মাধ্যমে প্রাক্তন হয়ে গেল। নিয়মরক্ষার বিদায়ীভাষনে বললাম, “আমার নতুন ঠিকানা সাউথ সুদানের জুবা নামক এক শহরে, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।” মিশনে যাবার উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়া করেই ঢাকা চলে এলাম, শুনলাম আগস্ট মাসেই ফ্লাইট।
রোটেশন মিশন মানে জিনিসপত্র যা যেখানে আছে সেভাবেই থাকবে বিদেশের মাটিতে, স্রেফ নতুন লোক যাবে আর পুরাতনেরা ফিরে আসবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদেরটা রোটেশন মিশন ছিলনা। ঢাকায় গিয়ে শুনি বিপসটে যেতে হবে এপিসি চালানো শিখতে, সাথে শান্তিরক্ষী হিসেবে প্রশিক্ষণও নিতে হবে। ‘শান্তিরক্ষী প্রশিক্ষণ’ কথাটা শুনতে সহজ মনে হলেও পেশাদার সৈনিক থেকে শান্তিরক্ষী হিসেবে রূপান্তর সত্যি কঠিন ব্যাপার; বিশেষতঃ মানসে আর মেজাজে। কিন্তু আসল যন্ত্রনা হল রোটেশন মিশন না হওয়ায় অস্ত্র-গাড়ি-তাবু সবই নতুন করে সংগ্রহ করে, জাহাজে তুলে নিয়ে যেতে হবে। যাহোক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে একদিন সরঞ্জামাদি নিয়ে জাহাজ পোর্ট সুদানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এই জাহাজ পোর্ট সুদানে ঠেকলেই আমরাও প্লেনে করে সুদানের উদ্দেশ্য উড়াল দেব। কিন্তু অক্টোবর যায়, নভেম্বর যায়, ডিসেম্বরও যায়। ফ্লাইটের কোন খবর নেই। স্লীম সাহেবের ফরগোটেন আর্মির মত আমরাও যেন ফরগোটেন কোম্পানি। কোম্পানি কমান্ডার প্রতিদিন নানান ফন্দি ফিকির করেন কোম্পানির মোরাল চাঙ্গা রাখার, কিন্তু হতাশা সবাইকে দিনরাত কুড়ে কুড়ে খায়।
জাহাজটা ঠিকই সময়মত পোর্ট সুদানে নোঙ্গর করেছিল। কিন্তু সুদান অধিপতি প্রেসিডেন্ট বশির এমনিতেই ইউএন এর উপর নাখোশ ছিলেন। তারউপর আরো একজাহাজ ইউএন সামানা তিনি তার দেশে ঢুকতে দিতে নারাজ। সপরিবারে আমরা আল্লাহ আল্লাহ করি, আল্লামা বশির সাহেবের দিলে যেন রহম হয়। কারন ইতোমধ্যে আমাদের পরে অন্যদেশের মিশনে যাদের নাম আসছে, তারা ছয় মাস মিশন শেষ করে ছুটি আসতে শুরু করেছে। আমাদের কোম্পানি টু আই সি মিজান স্যারের অবস্থা আরো শোচনীয়। ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কে তার মিশনে যাবার কথা ছিল। এরিমধ্যে তার কোর্সমেটরা মেজর র্যাঙ্ক পরতে শুরু করছে।যাহোক ফেব্রুয়ারি নাগাদ সব গিট্টু খুলল আর আমরাও এক মধ্যরাতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কাঙ্খিত বিচ্ছেদের নতুন অনুভুতি নিয়ে যখন আমাদের প্রিয়জনেরা বাসায় গিয়ে কেবল দু চোখের পাতা এক করছেন, তখনি দরজায় করাঘাতের শব্দ। সুদান সরকারের শেষমুহুর্তের জটিলতায় আমাদের ফ্লাইট বাতিল, তাই শেষরাতে আমরা সবাই আবার ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। ভালোই হল, সুদানে মিশনে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা সম্মন্ধে পরিবাররা আরো ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ পেল। যাহোক, পরদিন রাতে সবাইকে হতবাক করে সতি সত্যি আমরা সুদানের উদ্দেশ্যে উড়লাম। আমাদের অনেকেরই প্রথম বিমান যাত্রা। সন্দেহ একটা অবশ্য সবার মনেই ছিল, ইয়েমেন পর্যন্ত গিয়ে না আবার ফেরত পাঠায়। সম্ভবত সেকারনেই ইয়েমেনে যাত্রাবিরতির সময় জর্দানী ক্রুরা ফ্লাইটের কাউকেই নিচে নামতে না দেবার মত বর্বরোচিত আদেশ দেবার পরও, স্মোকাররাসহ কেউই কোন টু শব্দটিও করলনা!একরাশ মরীচিকা সাঁতরে বিমানটা জুবা রানওয়ে স্পর্শ করল। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই সুদানিজ রোদে দুচোখ ঝলসে গেল। ব্যানব্যাট-৪ এর সদস্যরা সাদরে স্বাগত জানাল আমাদের। অদুরেই ছোট্ট একটা চা চক্রের আয়োজন ছিল। সেখানেই দেখলাম নবাগত আর বিদায়ীদের অভিজ্ঞতা, মোবাইল সিম আর মুদ্রা বিনিময়ের সংক্ষিপ্ত অথচ তাতপর্যপুর্ন ঘটনা।
জেট ল্যাগ কাটিয়ে উঠার আগেই রাত কেটে গেল। সকালেই টরিট ক্যাম্পের অভিমুখে হেলিকপ্টারে চেপে বসলাম আমরা ত্রিশ জন। টরিট হল ইস্টার্ন ইকোটরিয়ায় অবস্থিত একটা ইউএন ক্যাম্প। এরা বলে টম্পিং সাইট অথবা টিম সাইট। চারপাশে মাটির দেয়াল ঘেড়া, ভেতরে ইউএন এর নানান পদের এমপ্লয়িরা থাকে। নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার আয়তন প্রায় ৮২, ৫৪২ বর্গ কিঃ মিঃ। কোম্পানি সাইজের একটা ফোর্সের জন্য বেশ বড়সড় এলাকাই বলতে হয়।
মিশন এলাকায় আমার অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি বিচিত্র। মিশন এলাকায় পা দেবার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় একেকজন যোদ্ধাকে শান্তিরক্ষীতে রুপান্তরের দুরুহ আর জটিল প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটা জটিল হলেও খুব জরুরী। ওয়েস্টার্ন যুবকেরা নাকি আর্মিতে যোগ দেয় চারটা কারনে। হয় এটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য, দাদা আর্মিতে ছিল, বাবাও ছিল, সেও চায়; নাহয় সে ভাবে সে দেশপ্রেমিক, আর্মিতে এসে সে দেশের জন্য কিছু করতে চায়; আর নাহয় যেকোন একটা চাকরী হলেই তার চলত, চান্স পেয়ে গেসে আর্মিতে, তাই চাকরি করবে; আর কিছু ব্যাতিক্রমী ক্ষেত্রে কিছুলোক বৈধ পথে মানুষ মারার লাইসেন্সটা ভালবাসে, তাই আর্মিতে ঢোকে। উপমহাদেশে যারা যে কারনেই আর্মিতে ঢুকুক না কেন, পশ্চিমাদের সাথে আমাদের জব মোটিভেশনে বিস্তর ফারাক আছে।
প্রথম ও দ্বিতীয়, উভয় মহাযুদ্ধে অসংখ্য ভারতীয় সৈনিক বৃটিশদের হয়ে লড়ে প্রান দিয়েছে। ইম্ফল-কোহিমার যুদ্ধেতো বৃটিশ-জাপান দুপক্ষের হয়েই লড়েছে। মজার কথা হল এরা কেউই কিন্তু বৃটিশ রানী অথবা ইউনিয়ন জ্যাকের জন্য প্রান দেয়নি। প্রান দিয়েছে তাদের কমান্ডার আর রেজিমেন্টের জন্য। এই রেজিমেন্টের জন্য আত্মবিসর্জনের ধারাটা সারা বিশ্বে পুর্ব থেকে পশ্চিমে ক্রমশ হালকা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমরা কিঞ্চিৎ পুর্ব দিকে পড়ে গিয়েছিলাম তাই রক্ষা। আর সেকারনেই শান্তিরক্ষী হিসেবে আমরা বেশ সহজাত। কেননা কঠোর রেজিমেন্টাল ঐতিহ্যের কারনেই আমাদের সৈনিকেরা পশ্চিমা সৈনিকদের মত সুরা আর সাকি তে অন্ধ আসক্ত নয়। তাই এহেন বিপর্যস্ত এলাকায় দ্রুত আমরা বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারি। আর শান্তিরক্ষায় বিশ্বস্ততার চে মোক্ষম আর কোন অস্ত্র নেই।
যুদ্ধ অথবা শান্তিরক্ষা মিশনের আরেক সুবিধা হল লোকবল আর রসদের পর্যাপ্ততা। তারপরও গোটা ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার আয়তন আমাদের জন্য একটু বেশিই ছিল বলা চলে। কাপোয়েতা ছিল আমাদের দুরবর্তী গন্তব্য, অথচ এরপরও আরো অন্তত ২০০ কিঃ মিঃ এলাকায় কোন ইউএন ফোর্স কখনই পা ফেলেনি। রাজধানী জুবার কয়েক কিলো বাদে গোটা সাউথ সুদানের সব রাস্তাই তখন কাচা ছিল। গুড়িগুড়ি লালচে নুড়ি পাথরের খানখন্দে ভরা রাস্তা, প্রায় জ্যামতিক ভাবে সরল রৈখিক। সুর্য যতক্ষন আকাশে থাকে ততক্ষনই প্রচন্দ তেতেই থাকে আর রাস্তার দুপাশে মাইলের পর মাইল বুক সমান উঁচু কাটাঝোপ। ইংরেজিতে বলে সাভান্নাহ। রাস্তার পাশে ক্বচিৎ কোন বড় গাছের দেখা মেলে। খানখন্দে ভরা কাচা রাস্তা ধরে আমাদের কনভয় ধুকতে ধুকতে এগিয়ে চলত।
কাপোয়েতা ছিল টরিটের পুর্বদিকে। বিশাল কাউন্টি; উত্তর, দক্ষিন আর পুর্ব কাপোয়েতায় বিভক্ত। পুর্ব কাপোয়েতায় শুনেছি স্বর্নখনি আছে, দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো, রহস্যময় কারনে ইউএন কখনও ওখানটায় যাওয়া পছন্দ করেনা। চুকুদুম আর ইকোটস পাশাপাশি কাউন্টি, পুরোটাই পার্বত্য এলাকা। রাস্তা বিপদজনক সব বাঁকে ভরা। কালো বীভৎস সব পাথরের পাহাড় দেখলে গা শিউরে ওঠে। গাড়ি নস্ট হয়ে কনভয় একবার ফেঁসে গিয়ে বেশ বিপদেই পড়েছিলাম। লাফোন মোটামুটি ফিচারলেস কাউন্টিই ছিল, কিন্তু কেনিয়া-উগান্ডা সীমান্তবর্তী মাগউই কাউন্টি ছিল ছবির মত সুন্দর।
কেনেটি নদীর ধারে টরিট ছিল এই এলাকার প্রানকেন্দ্র। কমবেশি ২২ টা এনজিও এই এলাকায় কাজ করত। আমাদের চেনা ব্র্যাকও ছিল। ছিল ব্র্যাকের বাংলাদেশি ভায়েরাও। এরা সবাই এখানে বিনাসুদে ঋণ দেয়। স্থানীয়রা আবার ঋণ শোধে একেবারেই সিরিয়াস না। তারপরও দেয়, ব্র্যাকও একি কাজ করে। স্বার্থটা কি বুঝিনি, বুঝতে চাইওনি। ২২ টা এনজিও নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে, অথচ দেশটা এককদমও এগুচ্ছেনা। এখানে পুরো একটা প্রজন্ম গত প্রায় ষাট বছর ধরে নর্থ সুদানের সাথে লড়ে চলেছে। অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। প্রত্যন্ত এলাকায় সুন্দর সুন্দর সব গীর্জা। সাউথ সুদান জুড়ে নানান অজুহাতে পশ্চিমাদের অবাধ আনাগোনা। কেউ মাইন সরায়, কেউ উদ্বাস্তু সামলায়, কেউ গভীর নলকুপ বসায়, কেউ রিসোর্ট চালায়, কেউ স্কুল-হাস্পাতাল চালায়।
এখানে পানির বোতলের চে বিয়ার সস্তা, আর স্থানীয়রা সেই বিয়ার আর চোলাই খেয়ে সারাদিন বুদ হয়ে থাকে। টাকা কুত্থেকে আসে, সেটাও এক রহস্য। সুদান পিপুলস রিপাব্লিকান আর্মি নামের একটা মিলিশিয়া নর্থ সুদানের আর্মির সাথে লড়ে তাই দেশটাও তারাই চালায়। সামনের রেফারেন্ডামে দেশটা ভাগ হবে, সাউথ সুদান নামে একটা নতুন রাস্ট্র জন্ম নেবে, সে বিষয়টা প্রায় নিশ্চিত। অথচ নতুন দেশের নাম কি হবে, পতাকা কেমন হবে সেসব নিয়ে কেউ কিছুই জানেনা। ২২ টা এনজিওর রাজনীতি বোঝা আমার মত লোকের পক্ষে বোঝা সত্যি কঠিন!
তিন
বিচিত্র হলেও সত্যি যে সাউথ সুদানের অর্থনীতি অনেকাংশেই গরু নির্ভর। গরুর সংখ্যা এখানে বিত্ত আর আভিজাত্যের নির্ধারক। যৌতুকপ্রথা এখানেও আছে। কনের বাবাকে ন্যুনতম দশটা গরু না দিতে পারলে বিয়ে হবেনা। তাই বলে ভালবাসাবাসিতে বাঁধা নেই। প্রায় অবাধ যৌনাচারের এই দেশে বিয়ের মোজেজাটা কি, সেটা জানতে চেয়েছিলাম এক স্থানীয় যুবকের কাছে। তার উত্তরে যা বুঝলাম তা হল, একমাত্র বিয়ে করলেই সে বউ পেটানোর লাইসেন্সটা পাবে, তখন আর এই কুকর্মেটির জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না! বৈধ হোক আর না হোক, সন্তানের যাবতীয় দায় যথারীতি মায়েদের। কাফ্রী ক্রীতদাসদের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। কাফ্রী মানে কালো, আরবীতে বলে সুদ বা সৌদ। সুদান যুগযুগ ধরেই ক্রীতদাসদের উৎস ছিল, অবাক করার বিষয় হল এখনও আছে!
সাউথ সুদানে গোত্র বা ট্রাইবের সংখ্যা প্রায় গোটা ষাটেক। মুখে আঁকিবুঁকি, কাটাচেরা আর উল্কি এইসব দেখে নাকি এদের আলাদা করে চেনা যায়। আমি অবশ্য আজো জাপানী আর চীনাদের তফাৎ বুঝিনা, তাই এদেরটা নিয়েও কখনও মাথা ঘামাইনি। আদি ধর্মে এরা সবাই ‘এনিমিস্ট’, খুব দ্রুত খ্রিস্টান আর ইহুদিতে রুপান্তরিত হচ্ছে আজকাল। প্রত্যন্ত এলাকায় এদের নগ্নতা সহজাত। দূর কাপোয়েতার রুক্ষ তপোসারা যেমন, তেমনি হোয়াইট নাইল পাড়ের তেরেকেকা কাঊন্টির আমুদে মুন্দারিরা। ভাগ্যিস এরা বহিরাগতদের নগ্নতা সংক্রান্ত অস্বস্তির ব্যাপারে যথেস্ট সচেতন।
বিষ্ময়ের ব্যাপার হল নীলনদের পাশে থেকেও এরা জালের ব্যবহার তেমন শেখেনি। এদের মাটি খুব উর্বর, আমাদের সৈনিকেরা অবসরে শখ করে দেশি কুমড়া, পেঁপের বীজ বুনে অবিশ্বাস্য ফসল ফলিয়েছে; অথচ এরা চাষাবাদ তেমন জানেই না। তৈরি পোষাক আর ঔষধ ব্যবসাটা প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করে চীনা আর ভারতীয়রা। এ এক সম্ভাবনাময় বাজার। অন্তত কৃষক উড়িয়ে এনে জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যদি এদের এগ্রো সেক্টরটাও টার্গেট করত, তা হত অত্যন্ত সফল বিনিয়োগ। অথচ অন্যান্য মিশন এলাকার মতই বাংলাদেশ সরকার এখানেও বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের জনপ্রিয়তাটাকে পুজি করে কোন ব্যবসায়িক সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
পাক-ভারতীয়দের নিরন্তর অপচেস্টার পরও সাউথ সুদানেও বাংলাদশী শান্তিরক্ষীরা সুনাম কুড়িয়েছে। পুবে ডিংকা-তপোসাদের সাথে যেমন টরিট টিম সাইট তেমনি পশ্চিমে ইয়াম্বিও টিম সাইট চমৎকার মানিয়ে নিয়েছিল স্থানীয় আজান্দেদের সাথে। সবাই বিপদ, উত্তেজনা আর ঝামেলার গল্প শুনতে চায়। অথচ ঝামেলাতেই শান্তিরক্ষীদের ব্যর্থতা। প্রতিটা মুহুর্তের সতর্কতার সমন্বয়েই ঝামেলামুক্ত শান্তিপুর্ন আরেকটা বছরের সাফল্য। আমাদের একটা বছর নিরাপদেই কেটে গেল, নতুন একটা দেশের জন্মগ্রহন দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারন নিশ্চয়। শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় একজন ক্যাপ্টেন ইফতেখারের মৃত্যু এড়ানো গেলনা শেষ অবধি!
যাহোক কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই রাতটা পার হল। সকাল সাতটার ভেতর আরেকটা রাশান হেলিকপ্টার চলে এল। হেলিকপ্টারের ইমার্জেন্সি ডোর খোলা নিয়ে এক পাইলট কিছুক্ষন গজ গজ করল, অবশ্য কারনটা বুঝিয়ে বলতেই বুঝল। ভদকাখেকো এই রাশান পাইলটদের পেশাদারিত্ব সত্যি ঈর্ষনীয়! একজোড়া হেলিকপ্টার নিয়ে ফিরতি পথে আমরা টরিট টিম সাইটে যাত্রাবিরতি নিলাম। মিশনের শুরুর অনেকটা সময় এই টিম সাইটেই কেটেছে আমার। সংক্ষিপ্ত বিরতির পুরোটা সময় তাই ক্যাম্পের উঠানের একলা নিম গাছের তলায় জম্পেশ আড্ডায় কাটিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে উড়াল দিলাম। জানিনা নতুন কোন এসাইনমেন্ট অপেক্ষা করছে জুবায়!পুনশ্চঃ
একটা গল্প অলরেডি পড়ে ফেললেন কিন্তু … হা …হা…হা…
‘শান্তিরক্ষী’ সংকলন শীঘ্রই আসছে,
হ্যাপি রিডিং…